বাংলাদেশ রাতারাতি পরিবর্তিত হয়েছে। যে স্বৈরাচারকে এক মাস আগে অবসান ঘটে এমন দৃশ্য কল্পনাও করা যায়নি, এখন তাঁর বিদায়ের বাস্তবতা আমরা দেখছি। শুধু ক্ষমতার সর্বত্রই তাঁর প্রভাব ছিল না, চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রেও তাঁর আধিপত্য ছিল প্রায় একক।
ইতিহাস সাক্ষী যে, যে কোনো ক্ষমতাধর সাম্রাজ্য অনন্তকাল স্থায়ী থাকে না। ক্ষমতার অতিরিক্ত দম্ভ ও বিরোধিতার প্রতি নিষ্ঠুরতা শাসককে অন্ধ করে তোলে। দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকা স্বৈরাচারী শাসকদের ক্ষেত্রে, বিশেষভাবে একটি অনুগত গোষ্ঠীর সহায়তা তাদের ক্ষমতায় থাকার প্রধান কারণ। এ গোষ্ঠীতে প্রশাসনের সদস্য, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, শিক্ষক এবং সাংস্কৃতিক নেতাদের উল্লেখযোগ্য অংশ অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এই ক্ষমতাভোগী গোষ্ঠী নিজেদের লাভের জন্য ছিন্নমূল রাজনীতিকদের সাহায্য করেছে, যদিও তাদের নৈতিক সান্ত্বনা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতিশ্রুতি ছিল। সমালোচনার মুখে তাঁরা যুক্তি দেখিয়েছেন যে, এই সরকার মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, ফলে তাঁদের বিকল্প নেই।
তবে, এটি অস্বীকার করার নয় যে, স্বৈরাচারী শাসক কখনো মুক্তিযুদ্ধের ধারক হতে পারেন না। এর ফলে সুবিধাভোগী গোষ্ঠীও তাঁর শাসনের নৃশংসতা এবং অদক্ষতা দায়ী।
স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে, যারা ক্ষমতার শীর্ষে আসেন তারা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারী হিসেবে পরিচিত করেছেন। যদিও গত পাঁচ দশকে ক্ষমতার বদল হয়েছে, কিন্তু নেতৃত্বের পরিবর্তন ঘটেনি। এর ফলে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে পুরোনো নেতাদের একটি বড় ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অপব্যবহার করার কারণে নব প্রজন্মের মধ্যে একটি বিরোধ জন্মেছে।
এছাড়া, নতুন প্রজন্ম, যারা আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে পরিচিত, বাংলাদেশের স্থবির রাজনৈতিক বাস্তবতা মেনে নিতে পারছে না। তারা আরব বসন্ত, লাতিন আমেরিকার নবীন নেতৃত্বের আবির্ভাব ও যুক্তরাজ্যের রক্ষণশীলদের নির্বাচনী বিপর্যয়ের ঘটনা দেখেছে। তাদের স্লোগান ছিল, ‘পরিবর্তন সম্ভব’, এবং তারা একটি অভাবিত বিপ্লব ঘটিয়েছে।
তবে, নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বে যে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, তা ‘বিপ্লব’ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিপ্লব মানে পুরোনো ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ। স্বৈরাচারী শাসকের পতনের পর, ক্ষমতায় ফেরার জন্য পুরোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠী প্রস্তুতি শুরু করেছে। বিশেষভাবে ধর্মীয় রাজনীতিকরা এই শূন্যতার সুযোগ নিয়েছে।
নতুন প্রজন্মের নেতারা এই সম্ভাবনা বা উদ্বেগে উদ্বিগ্ন নয়। তারা একটি দুর্নীতিমুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক সুশাসিত বাংলাদেশের কথা ভাবছেন। যারা পুরোনো ব্যবস্থার পুনরাবৃত্তি করতে চাইবে, তারা সাম্প্রতিক স্বৈরাচারের ভাগ্যই ভোগ করবে বলে নতুন প্রজন্ম দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেছে।
এই নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বে আমি আস্থাবান। তারা যা অর্জন করেছে, তা আমাদের জন্য একটি নতুন সম্ভাবনা উন্মোচন করেছে। আমাদের দায়িত্ব তাদের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করা এবং তাদের সংগ্রামের অংশ হওয়া। এদের ব্যর্থতা হলে, আমরা আমাদের শেষ সুযোগটুকুও হারাতে পারি।