• বুধবার, ২১ মে ২০২৫, ০৪:২৩ অপরাহ্ন

নিখোঁজ সংবাদ: মাদ্রাসার শিশু–কিশোরের সংখ্যা কেন বেশি

ডেস্ক রিপোর্ট / ৪৮ Time View
Update : বুধবার, ১০ জুলাই, ২০২৪

এক সপ্তাহ ধরে শিশু-কিশোর নিখোঁজের খবরাখবর ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। পোস্টগুলোতে দেখা যাচ্ছে, ‘২৪ ঘণ্টায় ১০ শিশু নিখোঁজ’, ‘৪৮ ঘণ্টায় ঢাকা ও চট্টগ্রামে ৩৫ শিশু নিখোঁজ’-এ ধরনের খবর। এসব পোস্টে অনেকগুলো নিখোঁজ সংবাদের ছবিসহ স্ক্রিনশটও রয়েছে।

বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপসহ পরিচিত-অপরিচিত সবাই এমন পোস্ট শেয়ার করছেন এবং আলাদাভাবে কোনো শিশুর নিখোঁজ সংবাদও শেয়ার হচ্ছে ব্যাপক হারে।

পুলিশ সদর দপ্তরের দেওয়া একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘শিশু নিখোঁজ’-সংক্রান্ত পোস্ট পুলিশের নজরে এসেছে। এ ধরনের পোস্ট নিছক গুজব। এমন গুজবে বিভ্রান্ত বা আতঙ্কিত না হতে সবার প্রতি অনুরোধ জানানো হয় পুলিশ সদর দপ্তর থেকে।

আসলেই কি শিশু-কিশোরেরা হারিয়ে যাচ্ছে?

পুলিশের এমন বক্তব্যের পরও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আতঙ্ক থেকে যায়। অনেকে সন্দেহ করছেন, এসব ছেলেধরার কাণ্ড। ফেসবুকের পোস্টগুলোতে দেওয়া নিখোঁজ শিশুদের অভিভাবকদের ফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হয়। গত সোমবার ৭ জনকে ফোন দিয়ে ১৩ জনের নিখোঁজের বিষয়ে জানা যায়। তাদের সবাইকেই এক দিন থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে ফেরত পাওয়া গেছে। তার মানে শিশু-কিশোর নিখোঁজের বিষয়টি গুজব বা ভুয়া নয়।

দেখা যাচ্ছে, সব ঘটনাই গত ১০ দিনের মধ্যে ঘটেছে। নিখোঁজ হওয়া সবাই শিশু-কিশোর, যাদের বয়স ৯ থেকে ১৬ বছর। নিখোঁজ শিশুদের মধ্যে দুজন স্কুলশিক্ষার্থী মেয়ে। অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রী নিজ জেলা শহর থেকে বাসে করে ঢাকায় চলে এসেছিল। বাসচালকের সন্দেহ হলে তাকে থানায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে পরিবার তাকে উদ্ধার করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলায় নয় বছরের এক মেয়ে ভিখারিকে চাল দেওয়ার সময় তার পিছে পিছে চলে যায়। পরে একটি ট্রেনে উঠে পড়লে যাত্রীরা তাকে উদ্ধার করে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।

নিখোঁজদের মধ্যে মাদ্রাসাশিক্ষার্থী বেশি

স্কুলপড়ুয়া দুই মেয়ে ছাড়া নিখোঁজ হওয়া বাকি ১১ জন সবাই ছেলে এবং মাদ্রাসাশিক্ষার্থী। তার মধ্যে চারজন হেফজ মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। আটজন শিক্ষার্থী পড়াশোনার চাপ বা পড়া না শেখায় শাস্তির ভয়ে মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে যায় বলে তাদের অভিভাবকেরা জানিয়েছেন। বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার একটি ঘটনার ক্ষেত্রে জানা গেছে, মাদ্রাসা থেকে শিক্ষার্থী হারিয়ে গেলে অভিভাবক বা পরিবারকে তা জানানো হয়েছে এক সপ্তাহ পর। জিডি করতে গেলে স্থানীয় থানা-পুলিশকে টাকাও দিতে হয়েছে তাঁদের। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার এক মাদ্রাসা থেকে একসঙ্গে চারজন পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। কয়েক দিন পর একই উপজেলার আরেকটি মাদ্রাসায় তাদের পাওয়া যায়।

নীলফামারী সদরের এক শিক্ষার্থী মাদ্রাসায় যাবে বলে ঘর থেকে বের হয়ে একটি হোটেলে কাজ নেয়। কয়েক দিন পর বিষয়টি হোটেলমালিক বুঝতে পারেন এবং তাকে ঘরে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। সাত-আট বছরের দুই মাদ্রাসাশিক্ষার্থীকে উদ্ধার করে স্থানীয় এক তরুণ নরসিংদীর মাধবদী থানায় নিয়ে আসেন। পরে থানা থেকে অভিভাবকেরা তাদের নিয়ে যান।

দৈনিক আজকের পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিখোঁজদের মধ্যে মাদ্রাসাশিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি। ২৫ জনের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিখোঁজ ১৯ জনই ঘরে ফিরেছে। ২৫ জনের মধ্যে ২১ জনই মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। যারা মূলত মাদ্রাসায় থাকতে অনীহা ও লেখাপড়ার প্রতি ভীতি থেকে নিরুদ্দেশ হয়েছিল।

ছেলেধরা ও প্রতারকের খপ্পরে

কিশোরগঞ্জের একটি ঘটনায় দুই হেফজ শিক্ষার্থী ছেলেধরার খপ্পরে পড়েছিল বলে তাদের অভিভাবক ধারণা করছেন। হারিয়ে যাওয়ার এক দিন পর নারায়ণগঞ্জের একটি এলাকা থেকে স্থানীয় লোকজনের মাধ্যমে তাদের উদ্ধার করা হয়। তাদের একজনের অভিভাবক প্রতারণার শিকারও হয়েছেন। তাদের ছেলেকে লাকসাম হাসপাতালে পাওয়া গেছে বলে পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি আট হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ফেসবুকে ছড়িয়ে যাওয়া নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তির ফোন নম্বর থেকে ওই অভিভাবককে ফোন দেওয়া হয়। পরে মুঠোফোন নম্বর ট্রেস করে জানা যায়, রাজধানী ঢাকা থেকে পুলিশের নাম ব্যবহার করে কোনো প্রতারক তাঁকে ফোন দিয়েছিল।

এক সংবাদকর্মী জানান, গত সোমবার তাঁর আত্মীয় স্থানীয় এক কামিল মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কসবা থানা এলাকা থেকে জোর করে রিকশায় তুলে নেন দুজন ব্যক্তি। এ সময় তার নাকের সামনে কিছু একটা দিলে সে অচেতন হয়ে যায়। মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকা থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়। জানা যায়, অপহরণকারীরা তাকে একটি গুদামে আটকে রেখেছিল। সেখান থেকে সে পালিয়ে আসে। তবে এ ঘটনায় অভিভাবকেরা থানায় কোনো অভিযোগ বা মামলা করেননি।

ফেসবুক পোস্টগুলোতে বলা হচ্ছে, ঢাকা-চট্টগ্রামেই বেশির ভাগ শিশু হারানো গেছে; কিন্তু বিষয়টি তেমন নয়। অনুসন্ধানে জানা যাচ্ছে, নিখোঁজের ঘটনাগুলো ঘটেছে গোটা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। যেমন বরিশালের বাকেরগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া, নরসিংদীর মাধবদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর ও আখাউড়া, নীলফামারী সদরসহ নানা জেলা-উপজেলায়।

অবাক করা বিষয় হচ্ছে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও নিখোঁজ সংবাদ নিয়ে এমন কাণ্ড দেখা গেছে। ফেসবুকে গত এপ্রিলে খোলা একটি পেজে শুধু নিখোঁজ সংবাদ নিয়েই সব পোস্ট করা হয়েছে। নিখোঁজেরা প্রায় সবাই দেশটির সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের। বেশির ভাগ ঘটনা গত এক মাসের। এর মধ্যে গত সপ্তাহে নদীয়ার একটি মাদ্রাসা থেকে একসঙ্গে ৯ শিক্ষার্থী নিখোঁজ হয়। পরে একজন ছাত্রের বাড়িতে তাঁদের খোঁজ পাওয়া যায়। মাদ্রাসায় থাকা অবস্থায় নানান অভিযোগে অভিভাবক ডাকার কথা বলা হলে ভয়ে তারা পালিয়ে যায় বলে ওই পেজেই মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ দাবি করে। এ ঘটনা সেখানে বেশ আলোড়ন তৈরি করে।

১৭ কোটির দেশে প্রতিদিন অনেক শিশুই হারিয়ে যায়। তবে শিশু নিখোঁজ-সংক্রান্ত আলাদাভাবে কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহরে চলতি মাসের প্রথম ৭ দিনে ৭৬ জন নিখোঁজের বিষয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। জুন মাসে এই সংখ্যা ছিল ২৬০ জন। ২০২৩ সালের ৪ জানুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাক এক প্রতিবেদনে বলছে, গেল বছর শুধু রাজধানী থেকেই নিখোঁজ হয়েছে প্রায় ছয় হাজার মানুষ। এর মধ্যে কত জন ফিরে এসেছে, সেই তথ্য নেই। শুধু ঢাকা শহরের চিত্রই বলে দেয়, গোটা দেশে কত মানুষ দিনে বা সপ্তাহে বা মাসে নিখোঁজ হয় এবং এখানে বড় একটি সংখ্যার শিশু-কিশোর হওয়াটা খুবই স্বভাবিক।


More News Of This Category
https://slotbet.online/