• শুক্রবার, ৩০ মে ২০২৫, ০৫:১৪ অপরাহ্ন

রক্তে ভেজা টি-শার্ট: সংগ্রামের স্মৃতি ও অনুপ্রেরণা

Reporter Name / ৪৬ Time View
Update : রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

১৫ জুলাই, সকালে মেসের বন্ধু ও রুমমেটদের মধ্যে একটি চাপা শঙ্কা আমাকে ঘিরে ধরেছিল। সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঘোষণা করেছিলেন—আন্দোলনকারীদের দমনে ছাত্রলীগই যথেষ্ট। তখনই আমি বুঝতে পারলাম, আজ আমাদের ওপর আক্রমণ আসবে। কিন্তু ঘরে বসে থাকার কোন উপায় ছিল না। অধিকার আদায়ের জন্য সোচ্চার না হলে, পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমরা কী জবাব দেব? আরেকটি বিষয় আমাকে অত্যন্ত অনুপ্রাণিত করছিল—আমাদের নারীরা। আন্দোলনে মেয়েরা কতটা অগ্রগামী, তা আমি নিজে দেখেছি। একজন বোন হাজারো বাধা অতিক্রম করে আন্দোলনে আসতে পারে, তাহলে আমি কেন পারব না?

সেদিন আমাদের কর্মসূচি ছিল শহরে। দুপুর আড়াইটার শাটল ট্রেনে উঠি, কিন্তু নির্ধারিত সময় পার হলেও ট্রেনটি ছাড়ছিল না। বাইরে বের হতেই দেখি, ছাত্রলীগের সিনিয়র নেতারা চট্টগ্রামের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফিকে জোর করে প্রক্টর অফিসে নিয়ে যাচ্ছে—তাঁর ছাত্রত্ব বাতিল ও আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ানোর মুচলেকা আদায়ের জন্য।

তখন আমরা, শাটলে থাকা সাধারণ শিক্ষার্থীরা, ক্যাম্পাসে আন্দোলন গড়ে তুলি। রাফিকে উদ্ধার করতে প্রক্টর অফিসের দিকে রওনা হই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের কাছে আসার পর আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায় ছাত্রলীগ। মিছিলে সামনের দিকে থাকার কারণে হামলাকারীদের সমস্ত হিংস্রতা আমার ওপর নেমে আসে। মাথায় মারাত্মক আঘাত পেয়ে শরীর রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। ধূসর রঙের টি-শার্টটি খয়েরি হয়ে যায় এবং রক্তক্ষরণ বন্ধ হচ্ছিল না। মনে হয়েছিল, হয়তো এটাই আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত। উপস্থিত একজন আমাকে রিকশায় করে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালে নিয়ে যান। চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে দ্রুত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেন। আমার মাথায় পাঁচটি সেলাই পড়ে। তখন রথযাত্রার সময় ছিল এবং আমার অনুষদের শিক্ষক ড. রূদ্রপ্রতাপ দেবনাথ স্যার ব্যস্ত রথযাত্রার মধ্যেও আমাকে দেখতে এসেছিলেন। ওই রাতেই আমার মেজ ভাই চট্টগ্রামে আসেন এবং পরদিন আমাকে লক্ষ্মীপুরে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়।

বাড়িতে এসে আমি শান্তিতে থাকতে পারিনি। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমার বিষয়ে লেখার পর আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা–কর্মীরা আমাকে আক্রমণ করেন। তারা আমাকে ‘নব্য রাজাকার’ হিসেবে অভিহিত করেন। শুনেছিলাম, আওয়ামী লীগের নেতারা আমার নাম তালিকাভুক্ত করেছেন—যেকোনো সময় গ্রেপ্তার বা সন্ত্রাসী হামলার শিকার হতে পারি। এই আতঙ্কে ঘরে ঘুমাতে পারতাম না। অধিকাংশ রাতই ছিল নির্ঘুম। তবু আমি দমে যাইনি। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর আবার আন্দোলনে যোগ দিই। মৃত্যুর ভয় তখন একেবারে কেটে যায়।

৫ আগস্ট—সব কষ্ট যেন নিমেষেই মিলিয়ে যায়। রক্তে ভেজা আমার টি-শার্টটি এখনো স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষণ করে রেখেছি। এটি পরবর্তী প্রজন্মকে বলার প্রমাণ হিসেবে থাকবে, তাদের পূর্বপুরুষরা কাপুরুষ ছিল না। এই টি-শার্ট অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে চিরকাল অনুপ্রেরণা জোগাবে।


More News Of This Category
https://slotbet.online/