• বুধবার, ২১ মে ২০২৫, ০৮:৪৫ অপরাহ্ন

জল্লাদ শাহজাহান: ফাঁসির দড়িতে বাঁধা জীবন কাহিনী

নিজস্ব সংবাদদাতা / ৪৩ Time View
Update : শনিবার, ২৯ জুন, ২০২৪

বাংলাদেশের ফাঁসির দড়ি যেন তার হাতের সঙ্গী। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নিষ্ঠুর কাজটি শাহজাহান ভোলা করেছেন, যাকে সাধারণত জল্লাদ শাহজাহান নামে চেনে সবাই। মৃত্যুদণ্ডের প্রক্রিয়াটি যে কতটা কঠিন এবং নৃশংস হতে পারে, তা তার কাজের মধ্য দিয়েই প্রতিফলিত হয়। কিন্তু এই কাজের পেছনে কেমন ছিলো শাহজাহানের জীবন? কেন এবং কিভাবে তিনি এই কাজে যুক্ত হলেন?

জীবনের শুরু

শাহজাহান ভোলার জন্ম ১৯৫৮ সালে বাংলাদেশের নরসিংদী জেলার একটি ছোট গ্রামে। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া শাহজাহানের জীবন ছোট থেকেই সংগ্রামের। গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা করে বেশি দূর এগোতে পারেননি। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ছোট বেলাতেই তাকে পরিবারের সহায়তা করতে কাজ শুরু করতে হয়।

অপরাধে জড়িয়ে পড়া

শাহজাহানের জীবন স্রোতে বাঁক আসে যখন তিনি কম বয়সেই বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭৮ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে তাকে প্রথমবারের মতো জেল হাজতে পাঠানো হয়। ১৯৮৯ সালে একটি বড় ডাকাতি এবং হত্যা মামলায় তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর তার জীবন জেলখানার কঠিন প্রাচীরের মধ্যে আটকে যায়। জেলে থাকার সময় তার জীবনের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন ঘটে, যখন তিনি তার কঠিন অতীতের কারণে জল্লাদের চাকরি গ্রহণ করেন।

১৯৯১ সালে শাহজাহান কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তরিত হন। সেখানে তার দক্ষতা এবং দৃঢ়তার কারণে তাকে জল্লাদ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। ১৯৯৮ সালে প্রথমবারের মতো তাকে ফাঁসির দড়িতে যুক্ত হতে হয়, এবং এরপর থেকে তিনি জল্লাদ হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করেন।

জল্লাদ হিসেবে শাহজাহানের কাজ ছিল অপরাধী বা দোষী সাব্যস্তদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা। এই কাজটি যেমন নিষ্ঠুর তেমনি মানসিকভাবে ভীষণ চ্যালেঞ্জিং। ফাঁসির দড়িতে থাকা অবস্থায় অপরাধী ও তার পরিবারের মর্মান্তিক আকুল আহ্বান তাকে মানসিকভাবে আঘাত করতো।

জল্লাদ শাহজাহানের বিখ্যাত ফাঁসির ঘটনা

শাহজাহান ভোলার জীবনের সবচেয়ে আলোচিত ফাঁসির ঘটনা হলো ২০১৩ সালে ঘটে যাওয়া যুদ্ধাপরাধী আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি। কাদের মোল্লা ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্ত এবং দোষী সাব্যস্ত একজন ব্যক্তি। এই ফাঁসি কার্যকরের দায়িত্ব পালন করতে পেরে শাহজাহান নিজেকে গর্বিত বোধ করেছিলেন, কারণ এটি ছিল জাতির পক্ষে সুবিচার প্রতিষ্ঠার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

কিভাবে শাহজাহান নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করেন?

জল্লাদ হিসেবে কাজ করার জন্য মানসিকভাবে শক্ত থাকা প্রয়োজন। শাহজাহান নিজের মানসিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করতেন। তিনি নিয়মিত প্রার্থনা করতেন এবং মনোযোগ ধরে রাখার জন্য নিয়মিত মেডিটেশন করতেন। অপরাধীদের ফাঁসি কার্যকরের পরিপ্রেক্ষিতে মানবিক এবং দার্শনিক চিন্তাভাবনাও তার মধ্যে গড়ে উঠেছিলো। তিনি নিজে বিশ্বাস করতেন যে, তিনি কেবল মাত্র তার দায়িত্ব পালন করছেন এবং এটিকে ব্যক্তিগতভাবে নেওয়া উচিত নয়।

অবসর এবং বর্তমান জীবন

দীর্ঘদিনের কষ্টসাধ্য এবং মানসিক চাপে ভরা জীবন থেকে অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন শাহজাহান। ২০১৮ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণের পর তিনি একটি সাধারণ জীবনযাপন করতে শুরু করেন এবং সামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত হন।

বর্তমানে, শাহজাহান সমাজের কল্যাণে কাজ করছেন। তিনি নিজে তার অতীতের ভুল থেকে শিখেছেন এবং এখন অন্যদেরকে সহায়তা করতে চান যাতে তারা অপরাধমূলক জীবন থেকে বিরত থাকতে পারে। তিনি বিভিন্ন স্কুল এবং সমাজিক সংগঠনে গিয়ে তরুণদের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাদেরকে অপরাধমুক্ত জীবন যাপন করতে উদ্বুদ্ধ করেন।

শাহজাহান ভোলা, যিনি একটি কঠিন এবং চ্যালেঞ্জিং কাজের মাধ্যমে তার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় পার করেছেন। তিনি তার অতীত থেকে শিখে নতুন পথে এগিয়ে গেছেন। তার জীবন কাহিনী আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় যে, জীবন কখনোই সরল পথে চলে না এবং আমরা আমাদের নিজেদের তৈরি করতে পারি আমাদের অভিজ্ঞতা এবং শিখা থেকে।

জল্লাদ শাহজাহান তার জীবন এবং কাজ আমাদের সমাজের একটি নির্দিষ্ট দিক প্রতিফলিত করে। আমরা যতই চেষ্টা করি না কেন, আমাদের আশেপাশে এই কঠিন এবং নৃশংস সত্যগুলি আমরা কখনোই পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারি না।


More News Of This Category
https://slotbet.online/