• বুধবার, ২১ মে ২০২৫, ০৯:৫৪ পূর্বাহ্ন

লালদীঘির ময়দানে ৬ দফা কর্মসূচির প্রথম ঘোষণা

Reporter Name / ৪১ Time View
Update : বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪

লালদীঘির পাড় থেকে মাত্র সাত মিনিটের হাঁটার পথ বক্সিরহাট মোড়, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের অগ্রপথিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা নুর মোহাম্মদ চৌধুরীর বাড়ি। ১৯৬৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে ৬ দফা কর্মসূচির প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ইতিহাসের সেই স্মরণীয় মুহূর্ত সম্পর্কে জানার জন্য নুর মোহাম্মদের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি ওই জনসভায় উপস্থিত ছিলেন, এবং সেদিনের স্মৃতি রোমন্থন করে তিনি বলেন, ‘‘সেদিনের কথা আমি কখনো ভুলব না।’’ ২৬ বছর বয়সী যুবক হিসেবে তখন যে ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী তিনি, আজ তা তিনি গভীর আবেগ ও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।

১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি, লাহোরে সম্মিলিত বিরোধী দলের বৈঠকে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মতো ৬ দফা কর্মসূচির প্রস্তাব উত্থাপন করেন। পরে ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ফিরে এসে তিনি সংবাদ সম্মেলনে এই কর্মসূচির বিস্তারিত জানান। তবে, চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে জনতার সামনে ৬ দফার প্রথম ঘোষণাটি দেওয়া হয় কয়েক দিন পর—২৫ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার। এখানেই প্রথমবারের মতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ৬ দফা কর্মসূচি জনসাধারণের সামনে তুলে ধরেন।

নুর মোহাম্মদ সেদিনের ঘটনা মনে করে বলেন, ‘‘তখন আমরা জানতাম না যে, এটি কত বড় ইতিহাস হয়ে দাঁড়াবে। তবে আজ মনে হয়, সেদিন আমরা এক ঐতিহাসিক ঘটনার অংশ ছিলাম।’’ সেদিন সকালে শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য নেতারা চট্টগ্রামে আসেন। তিনি উঠেছিলেন হোটেল শাহজাহানে। জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার সময় বঙ্গবন্ধু অক্ষরে অক্ষরে ৬ দফার মর্মকথা বুঝিয়ে দেন। এছাড়া, সন্দ্বীপের গায়ক শফি ভান্ডারী সুরে সুরে ৬ দফার বিষয়বস্তু তুলে ধরেন, যা উপস্থিত জনতার হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলে। নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘‘শফি ভান্ডারীর গান এখনও আমার মধ্যে গুনগুন করে বাজে।’’

ওই দিন ৬ দফা কর্মসূচির সমর্থনে একটি পুস্তিকা বিলি করা হয়, যার নাম ছিল ‘‘আমাদের বাঁচার দাবি ৬ দফা কর্মসূচি’’। শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা এই পুস্তিকার পেছনে লেখা ছিল, ‘‘তাজউদ্দীন আহমদ কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পক্ষে ১৫ পুরানা পল্টন, ঢাকা থেকে প্রকাশিত।’’ পুস্তিকায় বঙ্গবন্ধু ৬ দফার বিশদ বিবরণ দেন, এবং বলেছিলেন, ‘‘আমার প্রস্তাবিত ৬ দফায় পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে পাঁচ কোটি শোষিত মানুষের অন্তরের কথা প্রতিফলিত হয়েছে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘গোটা দেশবাসীর প্রতিক্রিয়া দেখে আমার সাহস বেড়ে গেছে, এবং আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, এই দাবিগুলো সত্যিই জনগণের মনের কথা।’’

চট্টগ্রামের প্রবীণ সাংবাদিক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী জানান, ৬ দফা আন্দোলন ছিল দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়, এবং চট্টগ্রাম ছিল এর কেন্দ্রবিন্দু। তখনকার সময়ে, চট্টগ্রাম ছিল রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণে আওয়ামী লীগ এখানে প্রথম জনসভাটি করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সভায় শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়াও বক্তব্য রাখেন খন্দকার মোশতাক আহমদ, এম এ আজিজ, মিজানুর রহমান চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল হারুনসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা।

একজন শহর আওয়ামী লীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক ইদরিস আল ইদরিস আলম তার স্মৃতিচারণে লিখেছিলেন, ‘‘শেখ মুজিব প্রথম চট্টগ্রামে ৬ দফার জনসভা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং ২৫ ফেব্রুয়ারি লালদীঘি ময়দানে সেই সভার আয়োজন করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন জহুর আহমদ চৌধুরী, এবং আমি সেই সভার প্রস্তাবগুলি লিখি।’’ দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলা হয়, ‘‘এ সভা পূর্ব পাকিস্তানের জননেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৬ দফার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছে এবং জনগণের প্রতি আবেদন জানাচ্ছে, যেন তারা এই কর্মসূচিকে গণ-আন্দোলনে পরিণত করে।’’

লালদীঘি ময়দানের সেই ঐতিহাসিক জনসভায় ৬ দফার সমর্থনে একটি যুগান্তকারী আন্দোলন শুরু হয়, যা বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠে। ৬ দফার পক্ষে এই প্রথম জনসমক্ষে ঘোষণার মাধ্যমে চট্টগ্রাম শহরের নাম চিরকাল স্মরণীয় হয়ে রইল।


More News Of This Category
https://slotbet.online/