গণতান্ত্রিক রূপান্তর একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, যার মূল ভিত্তি হলো সুষ্ঠু নির্বাচন এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার। অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূর্তির পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছেন, সেখানে তিনি নির্বাচনের গুরুত্ব এবং সংশ্লিষ্ট সংস্কারের বিষয়টি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। তাঁর ভাষণের মূল বার্তা ছিল, নির্বাচনী সংস্কারের মাধ্যমে যদি গণতন্ত্রের কাঠামো দৃঢ় করা না যায়, তাহলে তা কোনভাবেই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নির্বাচনী সংস্কারের একটি রোডম্যাপ প্রস্তুত হয়ে গেলে দ্রুত নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হবে। তবে, তাঁর মতে, এই সংস্কার কাজগুলি শেষ করার পরেই নির্বাচন আয়োজিত হবে। এটি নিশ্চিত করতে হবে যে, নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের আকাঙ্ক্ষা এবং অধিকার পূর্ণরূপে অর্জন করতে পারে। শুধু নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রকাশ করলেই চলবে না, প্রয়োজন তার সাথে কিছু মৌলিক সংস্কার, যা ভোটের মান, স্বচ্ছতা এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করবে।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উন্নয়ন এবং সাংবিধানিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য অবাধ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে গত ১০০ দিনের সরকার পরিচালনায় কিছু সাফল্য তুলে ধরেছেন। তবে, তিনি যে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা করছেন এবং কিছু আর্থিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন, তা সত্যি হলেও, বাস্তবতা হলো, গত সরকারের সময় থেকে চলে আসা নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া, সরকারের আর্থিক পরিস্থিতি বা বিদেশি ঋণ পরিশোধের মতো উদ্যোগগুলো যখন জনগণের প্রাথমিক চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়, তখন জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়।
গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য নির্বাচন ও সংস্কার দুটোই সমান্তরালভাবে এগিয়ে নিতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, নির্বাচনের রোডম্যাপ এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজ শেষ হলেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংস্কারের ক্ষেত্রে কিছু মতপার্থক্য রয়েছে, বিশেষ করে বিএনপি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। তাঁদের দাবি, নির্বাচনের সুষ্ঠুতা এবং শুদ্ধতা নিশ্চিত করতে হলে, প্রথমেই প্রয়োজন সেই পরিমাণ সংস্কার যা নির্বাচনকে একটি সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায় পরিণত করবে।
যদিও এখনো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থাহীনতা এবং কিছু ভুল বুঝাবুঝি রয়েছে, তবে প্রধান উপদেষ্টা পরিষ্কারভাবে জানিয়েছেন, সংস্কার ও নির্বাচনের বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যে পৌঁছানো জরুরি। এই ঐকমত্য না হলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কোনভাবেই সফল হবে না। এক্ষেত্রে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান এবং জনগণের মধ্যে সৃষ্ট গণতান্ত্রিক চাহিদা একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। এটি প্রমাণিত করেছে যে, দেশের মানুষ পরিবর্তন চাইছে, এবং সেই পরিবর্তন নির্বাচনের মাধ্যমেই সম্ভব।
নির্বাচন ও সংস্কার দুটোই অতীব গুরুত্বপূর্ণ, তবে একটির অভাব অন্যটির সফলতা বাধাগ্রস্ত করতে পারে। নির্বাচনের রোডম্যাপ এবং নির্বাচনী সংস্কার যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করা না হলে, গণতান্ত্রিক রূপান্তরের স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হতে পারে না। প্রধান উপদেষ্টা যেমন বলেছেন, নির্বাচনী ট্রেন একবার চলতে শুরু করলে আর থামবে না, তেমনি এটি নিশ্চিত করতে হবে যে, এই ট্রেন সঠিক পথে চলবে এবং গণতন্ত্রের সঠিক রূপটি প্রতিষ্ঠিত হবে।