বিশেষত, গত কয়েক দশকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বরাদ্দের পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যায়, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও গোপালগঞ্জ জেলা অধিক বরাদ্দ পেয়ে এসেছে, অথচ রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা এবং জয়পুরহাটের মতো উত্তরাঞ্চলের জেলা বরাদ্দের দিক দিয়ে সবচেয়ে কম পেয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রংপুর বিভাগের জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র ০.৯৮ শতাংশ, যা দেশের অন্যান্য অংশের তুলনায় অতি নগণ্য। এই বৈষম্য শুধু উন্নয়ন বরাদ্দে সীমাবদ্ধ নয়, বরং শিল্পায়ন, বেসরকারি উদ্যোগ, অবকাঠামো নির্মাণ এবং সরকারের বিভিন্ন মেগা প্রকল্পেও উত্তরাঞ্চলের ভূমিকা কম।
উত্তরাঞ্চলের পিছিয়ে পড়ার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে, তবে সবচেয়ে বড় কারণ হলো অবকাঠামো ও সরকারের অগ্রাধিকারে এই অঞ্চলের অবহেলা। দেশের বৃহত্তম কৃষিজ উৎপাদক অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও, রংপুরে শিল্পায়ন তেমন উন্নত নয় এবং এখানকার মানুষজন কৃষিকাজের জন্য দিনমজুর হিসেবেই কাজ করে। সম্প্রতি ২০২৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রংপুরের জনসংখ্যার ১৩.৫২ শতাংশ কৃষি দিনমজুর হিসেবে কাজ করছেন, অথচ এখানকার মানুষগুলো তাদের মৌলিক চাহিদা মেটাতেও হিমশিম খাচ্ছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, এবং সামাজিক সুরক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ না পেলে মানব উন্নয়ন সম্ভব নয়।
এটি বৈষম্যের একটি প্রকৃত চিত্র, যা সরকারের উচিত শিগগিরই পর্যালোচনা করা। কেননা, দেশের উন্নয়ন সবার জন্য সমান হতে হবে এবং একটি অঞ্চলকে উপেক্ষা করে অন্য অঞ্চলকে এগিয়ে নেওয়া কোনোভাবেই সঠিক নয়। বৈষম্য দূর করতে হলে, প্রথমত আঞ্চলিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমান উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। যদি একটি অঞ্চলের জনগণ সরকারের সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকে, তবে সে জনগণের মধ্যে অস্থিরতা এবং বৈষম্যের অনুভূতি বৃদ্ধি পাবে, যা সামগ্রিক উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আঞ্চলিক বৈষম্য মোকাবেলায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সুষম উন্নয়ন নীতি গ্রহণ। এটি শুধু অর্থনৈতিক বরাদ্দের সমতা নয়, বরং প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন ও এর সুফল মানুষের কাছে পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হবে। সুষম উন্নয়ন নীতি এবং আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণে রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের উচিত সঠিকভাবে পর্যালোচনা করা যে, কীভাবে উত্তরাঞ্চলের মানুষের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে এবং কীভাবে তাদেরকে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে এই সুযোগ রয়েছে, কারণ জনগণের মধ্যে এক ধরনের নতুন আশা জন্ম নিয়েছে। আঞ্চলিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন গড়ে উঠছে, বিশেষ করে উত্তরের জনগণের মধ্যে, যারা মনে করছেন, তাদের শেকড় এবং সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের জন্য সুবিচার নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। নতুন প্রজন্মের এই দাবির পেছনে রয়েছে সেই ইতিহাস, যেখানে গণ-অভ্যুত্থান ও আন্দোলনের মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে জেগে ওঠা জনগণ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
তাহলে, সরকারের জন্য এটা জরুরি যে তারা আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করতে একটি কার্যকরী রূপরেখা তৈরি করুক। যেখানে ঢাকা বা চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলোর পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলও উন্নয়নের কাঠামোয় সমান অংশগ্রহণ করবে। এর মাধ্যমে শুধু অর্থনৈতিক সমতা প্রতিষ্ঠিত হবে না, বরং দেশের সব অঞ্চলের জনগণের মধ্যে সমতার ধারণা প্রতিষ্ঠিত হবে, যা এক জাতি হিসেবে আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ সুগম করবে।