১৯৮৭ সালের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের দিনগুলোতে শেখ হাসিনা মাঝে মাঝে প্রেসক্লাবে আসতেন। আমি তখন তাঁর একজন প্রিয় সাংবাদিক ছিলাম, যদিও আমি তাঁর দলের রাজনীতির সমর্থক ছিলাম না। আমাদের সম্পর্ক ছিল সম্পূর্ণ পেশাদার। এক সকালে, শেখ হাসিনা প্রেসক্লাবে এসে চা খেতে বললেন এবং জানিয়েছিলেন যে তিনি ৩২ নম্বর সড়কে মুজিবের বাসভবনকে জাদুঘর বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটি একটি অপ্রত্যাশিত ঘোষণা ছিল, কারণ ওই প্লটটি ডিআইটি/রাজউকের আবাসিক এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিল। আমি জানতে চেয়েছিলাম, সেখানে জাদুঘর নির্মাণের অনুমতি পাওয়া যাবে কি না। তিনি দৃঢ়ভাবে উত্তর দিয়েছিলেন, “হ্যাঁ, আমি ঠিক করে এসেছি।”
শেখ মুজিবুর রহমানের এই বাসভবনের ইতিহাস অনুযায়ী, ১৯৫৮ সালে তিনি ধানমন্ডির ওই প্লটটির জন্য আবেদন করেছিলেন এবং ছয় হাজার রুপি মূল্যে এটি বরাদ্দ পেয়েছিলেন। ১৯৬০ সালে কারামুক্ত হয়ে তিনি ওই প্লটটিতে একটি একতলা বাড়ি নির্মাণ করেন এবং সেখানেই বসবাস করতে থাকেন।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছিল, আবাসিক এলাকার প্লটে জাদুঘর নির্মাণের উদ্যোগের পিছনে কি ঐতিহাসিক ঘটনা ব্যবহারের চেষ্টা আছে? ইতিহাসবিদরা অনেক সময় বলেন, তিন পুরুষের কেউ যদি একটি ঐতিহাসিক ঘটনার ইতিহাস লেখেন, তবে তা নিঃসন্দেহে পক্ষপাতদুষ্ট হয়। ইতিহাসে রাজা-বাদশা ও রাজনৈতিক নেতারা প্র spesso নিজস্ব স্বার্থে ঐতিহাসিক ঘটনা এবং স্মৃতিচিহ্ন নির্মাণ করেছেন।
এখন, ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর গণভবনকে জাদুঘর হিসেবে রূপান্তরের উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা চলছে। এটি বর্তমান পরিস্থিতির প্রতিফলন বা বিজয়ীর হাতে ইতিহাস রচনার বিষয় কি না, সে বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রচলিত ধারণা অনুসারে, বিজয়ী ইতিহাস লেখেন এবং তা সব সময় সত্যনির্ভর হয় না। ব্লগার শুভম জৈনের মতে, “যারা কোনো ঘটনা থেকে সুবিধা পায়, স্বল্প সময়ের জন্য তারা ইতিহাস বিকৃত করে।”
গণভবন জাদুঘর নিয়ে আমার প্রস্তাবের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া আমি পেয়েছি। এম রশিদ আহমেদ নামের একজন চিকিৎসক বলেছেন, “সময় বদলে যায়। জাদুঘর বানানো হঠকারিতা।” এই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে আমার যুক্তি, তেভাগা আন্দোলন বা ভাষা আন্দোলনের সময় শহীদ মিনারের নির্মাণকাজও দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করা হয়েছিল। এসব উদ্যোগ ইতিহাসের অংশ হিসেবে অমর হয়ে থাকে।
১৯৮৭ সালের এরশাদবিরোধী আন্দোলনের নূর হোসেনের ত্যাগ আমাদের মনে রাখতে হবে। নূর হোসেনের আত্মত্যাগ এবং সংগ্রামের স্মৃতি আমাদের ইতিহাসের অংশ। গণভবনকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হলে, এটি শুধু সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানের ইতিহাসের প্রতীক নয় বরং একটি সামষ্টিক আন্দোলনের ইতিহাস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
তেভাগা আন্দোলন, নাচোলের কৃষক বিদ্রোহ, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯-এর ১১ দফার আন্দোলন, ৮৩-এর শিক্ষানীতিবিরোধী আন্দোলন, এবং ৯০-এর এরশাদবিরোধী আন্দোলনের বিভিন্ন স্মারক সংগ্রহে রাখা উচিত। বিশেষভাবে, আবু সাঈদের বুকে গুলি চালানোর বন্দুক এবং অন্যান্য ঐতিহাসিক অস্ত্রও রাখা উচিত। এসব সংগ্রহ আগামী প্রজন্মকে আন্দোলনের ইতিহাস এবং বিশ্বাসঘাতকতার সম্পর্কে সচেতন করবে।
এই জাদুঘর শুধুমাত্র একটি ব্যক্তির নয়, বরং হাজার হাজার মানুষের আত্মত্যাগের ইতিহাস। এটি ৩২ নম্বর সড়কের ইতিহাসের সাথে তুলনামূলকভাবে টেকসই এবং চিরকাল অমর হতে পারে।