প্রথমত, হাসিনা সরকারের পতনের কারণ খুঁজতে গেলে, একাধিক জনআকাঙ্ক্ষার ছবি সামনে উঠে আসে। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনার শাসনকাল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রথম মেয়াদে তিনি নির্বাচিত হলেও পরবর্তী তিনটি নির্বাচন ত্রুটিপূর্ণ ছিল। ফলে, অনেকেই মনে করে যে তাঁর সরকার একটি অবৈধ সরকার হিসেবে অবস্থান করছে। আমাদের প্রজাতন্ত্রে জনগণের মালিকানা কেবল নির্বাচনের মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়। যদি সেই অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়, তাহলে জনসাধারণের পক্ষে সরকারকে উৎখাত করার ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকে না।
হাসিনা সরকারের বৈধতার জন্য যে দুটি প্রধান বয়ান ছিল তা হলো মুক্তিযুদ্ধের একদলীয় ব্যাখ্যা ও উন্নয়নের বয়ান। মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে সরকারের ব্যাখ্যা অর্ধসত্য, যা অসত্যের চেয়েও মারাত্মক হতে পারে। উন্নয়নের কথা বলতে গেলে, জনগণের উন্নয়ন তেমন লক্ষণীয় হয়নি। আয়-বণ্টনের বৈষম্য বেড়েছে, যা জনসাধারণের মধ্যে হতাশা ও আফসোসের জন্ম দিয়েছে। আর্থিক দুর্নীতি এবং বেকারত্বের সমস্যা, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সূচনাও করেছে।
জনআকাঙ্ক্ষার মধ্যে প্রধান বিষয় হলো মানুষের মর্যাদা রক্ষা। হাসিনা সরকারের অধীনে সাধারণ মানুষের মতামত উপেক্ষিত হয়েছে এবং তাঁদের বৈষয়িক স্বার্থ লঙ্ঘিত হয়েছে। সাইবার নিরাপত্তা আইনসহ বিভিন্ন আইন সাধারণ মানুষের সমালোচনা ও পরিহাস করার অধিকার কেড়ে নিয়েছে। এর ফলে, সরকার প্রকৃতপক্ষে প্রতিনিধিত্বশীল হয়নি।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্রদের আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে উৎখাতের একটি সুযোগ পেয়েছে। ছাত্ররা জনগণের কাছে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে এবং তারা তাঁদের সাহস ও দূরদৃষ্টির কারণে সাফল্য অর্জন করেছে। সরকারের প্রতি জনগণের ক্ষোভ বেড়ে যাওয়ার পেছনে বেকারত্ব, আর্থিক দুর্দশা, এবং ব্যাপক দুর্নীতির চিত্র রয়েছে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ হলো, পূর্ববর্তী সরকারের আমলে সৃষ্ট বিশাল জঞ্জাল পরিষ্কার করা এবং একটি নতুন ব্যবস্থা গড়ে তোলা। বিশেষ করে, সংবিধানের মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে, ১৯৯০ সালের আন্দোলনের মতো ভবিষ্যতে নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হওয়ার প্রয়োজনীয়তা পুনর্ব্যক্ত করা হচ্ছে।
বর্তমান সংবিধান সংস্কারের জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক বিবেচনায় রাখতে হবে। যেমন, নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং বেসরকারি বাহিনীর কার্যকলাপের সীমাবদ্ধতা। অতীতে ঘটে যাওয়া দমনমূলক কার্যকলাপ, যেমন বন্দুকযুদ্ধ, গুম, এবং নির্বিচার হত্যা, বন্ধ করতে হবে। সংবিধানের মৌলিক অধিকারগুলোর লঙ্ঘন বন্ধ করার জন্য সংশোধনী আনতে হবে।
রাজনৈতিক সংস্কারের অংশ হিসেবে, নতুন সংবিধান প্রণয়নের প্রয়োজন হতে পারে, যা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের আদর্শ গ্রহণ করে গঠন করা যেতে পারে। সংবিধানে আইনসভার ক্ষমতাকে সর্বোচ্চ স্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচন ও সংস্কার পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। সঠিক সময়ে নির্বাচন ও সংস্কারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।
সংবিধান সংশোধন এবং নতুন নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য, জনগণের সমর্থন জরুরি। গণতন্ত্রের মূল কথা হলো, সকলের প্রয়োজন অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা। তাই, মৌলিক সংস্কারের মাধ্যমে একটি সুশাসিত এবং সমতামূলক সমাজ গঠন করা সম্ভব হবে।