এই পঙ্ক্তিগুলো যদি কোনো নারীর হয়, তবে সহজেই বোঝা যায় যে এটি পুরুষতান্ত্রিক রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের স্বর। তবে যদি এটি পাকিস্তানের কোনো কবির লেখা হয়, তাহলে এর গুরুত্ব আরও গভীর এবং বহুমুখী হতে পারে।
পাকিস্তানের উর্দু কবি কিশওয়ার নাহিদ এরকম অনেক প্রতিবাদী কবিতার রচয়িতা। তার কবিতাগুলি বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং তিনি নারীবাদী উর্দু কবি ও অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে পরিচিত। স্বীকৃতি পাওয়ার পাশাপাশি তিনি রাষ্ট্রীয় লাঞ্ছনা ও অবিচারের শিকার হয়েছেন। কিশওয়ার নাহিদ তার কবিতার মাধ্যমে নিপীড়িত নারীর এবং সাধারণ মানুষের মুক্তির কথা তুলে ধরেছেন।
১৯৪০ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের বুলন্দ শহরে জন্মগ্রহণ করেন কিশওয়ার নাহিদ। ভারতভাগের পর তাঁর পরিবারকে পাকিস্তানে চলে যেতে হয়। সাত বছরের কিশওয়ার দেশভাগের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছেন। দেশান্তরিত হওয়ার আগের দিন প্রতিবেশী বহু নারী অপহৃত হয়ে ফিরে এসেছিল শারীরিক ও মানসিকভাবে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে। এই দুঃসহ স্মৃতি কিশওয়ারের মনে অমোচনীয় চিহ্ন রেখে গেছে। পাকিস্তানে এসে নতুন জীবন শুরুর পরও নারীর নিরাপত্তার অভাব এবং বিদ্যালয়ে যাওয়ার স্বাভাবিক পরিবেশের অভাবে কিশওয়ার অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। কবিতাচর্চা ও প্রগতিশীল কার্যক্রমের জন্য তাকে নানা অবিচার সহ্য করতে হয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়াউল হকের শাসনামলে তার দুই সন্তানকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা।
বিরোধী কবি কিশওয়ার তার কবিতায় নিজেকে ‘পাপী নারী’ হিসেবে অভিহিত করেছেন: “আমরা এই পাপী নারীরা/ জোব্বাধারীদের গর্বিত প্রতাপে/ হইনি সন্ত্রস্ত/ না প্রাণ বিক্রয় করেছি /না হাতজোড় করেছি… / যেসব জিভ পারত বলতে তাদের দেওয়া হয়েছে কেটে।” এসব অভিব্যক্তি তার সাহসী প্রতিবাদ ও অদম্য মনোভাবের পরিচায়ক।
যতটা যন্ত্রণা সহ্য করেই হোক, কিশওয়ার নারীর মুক্তির প্রশ্নে আপসহীন। তার কবিতায় অভিমান, ক্ষোভ, ব্যঙ্গের তীক্ষ্ণতা ও সাহসী প্রতিবাদ একত্রে উপস্থিত থাকে। তিনি এমনভাবে লেখেন, “তুমি আমাকে কাঁদাতে পারো/ আমি নিজেই নিজেকে হত্যা করে/ নিজের রক্তকে পানি-পানি করে/ চোখের মাঝে ঝিল বানিয়ে নিয়েছি।” কিশওয়ারের কবিতায় দ্রোহ ও প্রেম একসঙ্গে চলতে দেখা যায়।
‘নির্বাচিত কবিতা: কিশওয়ার নাহিদ’ নামে পাকিস্তানের এই কবির সংকলিত বইটি উর্দু থেকে অনুবাদ করেছেন সফিকুন্নবী সামাদী। সফিকুন্নবী সামাদী উর্দু ও হিন্দি থেকে অনুবাদ করার দক্ষতা দেখিয়েছেন। কিশওয়ার নাহিদের কবিতা ও গজলগুলির বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে পাঠকদের সামনে তুলে ধরা তার একটি বিশিষ্ট প্রয়াস। কবিতার ভাষার প্রাঞ্জলতা ও কাব্যময়তা গ্রন্থটিকে পাঠক বান্ধব করে তুলেছে এবং এতে কবিতার সঠিক রসও উপভোগ করা যায়।
এই অনুবাদ কেবল কবিতার ভাষা নয়, এর রসও পাঠকদের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছে দেয়, যা অনুবাদক সফিকুন্নবী সামাদীর দক্ষতার প্রমাণ।