• বুধবার, ২১ মে ২০২৫, ০৪:০৭ অপরাহ্ন

বিচারের জন্য দাবি: মৌমিতা দেবনাথের কষ্ট

Reporter Name / ৪০ Time View
Update : শনিবার, ১৭ আগস্ট, ২০২৪

৮ আগস্ট ২০২৪ ও ৯ আগস্ট ২০২৪

চোখের পাতা ধীরে ধীরে বন্ধ হচ্ছে, নিশ্বাসের গতি রুদ্ধ হয়ে আসছে। শরীরটি ক্ষতবিক্ষত, দেহের প্রতিটি অংশে দানবীয় আঘাতের চিহ্ন। রক্তের মতো ক্ষত থেকে জল পড়ছে—যন্ত্রণায় ভরা এই অবস্থায় বুঝতে পারছি, শীঘ্রই আমার আত্মা এই দেহের বন্ধন ছিন্ন করবে। কতই না স্বপ্ন ছিল—একটি সুন্দর জীবন, সুখী পরিবার, শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ। কিন্তু কিছু মুহূর্তের মধ্যেই সব কিছু শেষ হয়ে গেল একদল হিংস্র মানুষের হাতে।

আমি মৌমিতা দেবনাথ, চিকিৎসক। আর জি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চেস্ট ডিপার্টমেন্টে স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষানবিশ চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছি। আমার পরিবারের প্রচুর ত্যাগ ও কষ্টের ফসল এই চিকিৎসা শিক্ষা, আর আমি সর্বদা মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রত্যাশায় এসেছি এই পেশায়। চিকিৎসক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করার প্রেরণা নিয়ে মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করেছি। এখন বয়স ত্রিশের কাছাকাছি, ধীরে ধীরে আমার স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যাচ্ছি। আমার প্রাপ্তি, অর্থ উপার্জন—এগুলি আমার পরিবারের কষ্টের ফল। আমি এখন কিছু শখ পূরণ করতে পারছি, যা আমার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে।

৮ আগস্টের রাতটিতে আমি টানা ৩০ ঘণ্টার ওপরে ডিউটি করেছি। একটি জটিল কেস—হার্ট অ্যাটাক—আমাকে তীব্র চাপের মুখে ফেলেছিল। রোগীটি গুরুতর অবস্থায় ছিল, তবে আমি সৃষ্টিকর্তার কৃপায় তাকে বাঁচিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি। রোগীর আত্মীয়রা আমাকে দেবতুল্য সম্মান দিতে শুরু করেছিল। চিকিৎসার ক্ষেত্রে যে আনন্দ আমি পাই, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

তবে রাত এগারোটা বেজে পঁইত্রিশ মিনিটে ভারতীয় অলিম্পিক অ্যাথলিট নীরজ চোপড়ার জ্যাভলিন থ্রোর ইভেন্ট শুরু হয়েছিল। যদিও রাতের খাবার ভাগাভাগি করে নেওয়ার পর ক্লান্তি সত্ত্বেও আমি একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য সেমিনার হলে চলে গিয়েছিলাম। সেমিনার হল ছিল পুরোপুরি ফাঁকা, আমি একাই ছিলাম। ক্লান্তি থেকে বই পড়ার চেষ্টা করলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

হঠাৎ ঘুম ভাঙার পর কিছু মানুষরূপী হায়েনার উপস্থিতি অনুভব করলাম। তারা আমার পরিচিত মুখ, আমার সম্মানের পরেও তারা আমাকে ভয়ঙ্করভাবে আক্রমণ করল। তাদের আচরণ ছিল অত্যন্ত হিংস্র এবং যৌনতা পূর্ণ। তারা আমার শরীরের ওপর অত্যাচার চালালো, আমাকে অপমানিত করল। আমি তাদের কাছে বারবার আবেদন করলাম, সাহায্য চাইলাম, কিন্তু তারা একবারও আমার কথা শুনল না।

এই অভিজ্ঞতা জীবনের এক ভয়াবহ অধ্যায় হয়ে উঠেছে। এতটাই নির্মমতা, যে আমাকে মনে হচ্ছে—মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়াটা আমার সবচেয়ে বড় শাস্তি। আমি এই নির্মমতার সাক্ষী হয়ে থাকার পর, আমার আত্মার প্রতি স্বাভাবিক সম্মাননা কি সত্যিই অযথা?

যদি বিকৃত যৌনতা পুরুষত্বের পরিচায়ক হয়, তাহলে আমি সেই পুরুষজাতির প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করছি। সেই পিতাদের প্রতি ঘৃণা, যারা ধর্ষণের পর সন্তানকে স্নেহ করে; সেই ভাইদের প্রতি ঘৃণা, যারা ধর্ষণের পর বোনের হাতে ভাইফোঁটা নেয়; সেই সন্তানদের প্রতি ঘৃণা, যারা ধর্ষণের পর মা-বাবার সামনে দাঁড়ায়।

এখন আমি জানি না, আমি বাঁচব কিনা। তবে আমার দেহের প্রতিটি ক্ষত সাক্ষ্য দেবে—আমার হত্যার যন্ত্রণা কতটা ছিল।

আমার জন্য কি কেউ দাঁড়াবে? ন্যায়বিচার কি আমার প্রাপ্য নয়? আমি মৌমিতা দেবনাথ, আমার জন্য ন্যায়ের দাবি করছি।

লেখক: সিফাত আল সাদ (স্মরণ), শিক্ষার্থী, স্নাতকোত্তর, শান্তি, সংঘর্ষ ও মানবাধিকার অধ্যয়ন, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি), ঢাকা।


More News Of This Category
https://slotbet.online/